সরলবর্গীয় অরণ্য (Coniferous Forest) সম্পর্কে আলোচনা কর।
বন্ধুরা আজকে আমি নিয়ে এসেছি পরিবেশবিজ্ঞান এর একটি গুরুত্বপূর্ণ topic নিয়ে। এই topic টি তোমরা ভূগোলে ও দেখতে পাবে। এটি খুবই একটি মজাদার topic। আজকে আমরা আলোচনা করবো সরলবর্গীয় অরণ্য (Coniferous Forest) সম্পর্কে।আজকে আমরা সরলবর্গীয় অরণ্যের অবস্থান, ভৌগোলিক পরিবেশ, প্রধান বৃক্ষ, বনভূমির বৈশিষ্ট্য, অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক গুরুত্ব বা ব্যবহার, সরলবর্গীয় অরণ্যে কান্তশিল্প গড়ে ওঠার কারণ বা উন্নতির কারণ নিয়ে আলোচনা করেছি নিচে। এটি মাধ্যমিকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরটি আমার খুবই উপকার করেছে। তো বন্ধুরা তাই বলছি আপনারাও এই প্রশ্নের উত্তরটি অনুসরণ করুন অবশ্যই। যদি আপনার উত্তরটি ভালো লেগে থাকে তাহলে আপনি সেভ করে রাখতে পারেন এবং বাকি বন্ধুদের share ও করতে পারেন।
সরলবর্গীয় অরণ্য (Coniferous Forest)
অবস্থান
অক্ষাংশগত অবস্থান: সরলবর্গীয় বনভূমি 50° থেকে 70° উত্তর অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত। তবে 50°-55° দক্ষিণ অক্ষাংশেও এই অরণ্য কিছু পরিমাণ দেখা যায়।
দেশীয় অবস্থান:
[1] কানাডার- পূর্বাংশের কুইবেক ও অন্টারিও প্রদেশে এই অরণ্য সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কানাডার 40% এলাকা এই অরণ্যে ঢাকা।
[2] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের- প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল অঞ্চল, রকি পার্বত্যভূমির কিছু অংশ, আলাস্কা, মিনেসোটা, উইসকনসিন, ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাডা, আইডাহো প্রভৃতি রাজ্যে এই অরণ্য অবস্থান করতে দেখা যায়।
[3] ইউরোশিয়ার- সরলবর্গীয় অরণ্য পৃথিবীর বৃহত্তম অরণ্যাঞ্চল। এটি পশ্চিমে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন থেকে শুরু করে ফ্রান্স, জার্মানী প্রভৃতি দেশ হয়ে রাশিয়ার মধ্য দিয়ে একেবারে পূর্ব প্রান্তের প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত একটানা বিস্তৃত। রুশভাষায় তৈগা শব্দের অর্থ 'পাইন বন'।
[4] অন্যান্য অঞ্চল- দক্ষিণ গোলার্ধে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ অংশে এবং নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ দ্বীপে সরলবর্গীয় অরণ্য দেখা যায়। এছাড়াও জাপানের হোক্কাইডু দ্বীপে, ভারতের হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলেও কিছু পরিমানে এই অরণ্য দেখা যায়।
ক্ষেত্রমান: 2000 সালের হিসাব অনুসারে পৃথিবীতে এই বনভূমির আয়তন প্রায় 100 কোটি হেক্টর। পৃথিবীর মোট বনভূমির প্রায় 37% হল সরলবর্গীয়।
ভৌগোলিক পরিবেশ
সরলবর্গীয় বৃক্ষের অরণ্য উচ্চ অক্ষাংশের শীতল নাতিশীতোয় জলবায়ুর অন্তর্গত। এখানে গড় উন্নতা 10°C এবং বৃষ্টিপাত 30 থেকে 50 সেমির মধ্যে সীমাবদ্ধ। শীতকালে এখানে প্রচণ্ড তুষারপাত হয় এবং তাপমাত্রা -50°C এর কাছাকাছি নেমে যায়। এখানে পডজল ও চার্নোজেম শ্রেণির উর্বর মাটি দেখা যায়।
প্রধান বৃক্ষ
সরলবর্গীয় অরণ্যের প্রধান বৃক্ষগুলি হল-
[1] তৈগা বনভূমিতে নানা প্রজাতির পাইন, যেমন-চিরপাইন, দেওদার পাইন, সূচিমুখ পাইন, বিভিন্ন প্রকার ফার, যেমন-রুপোলি ফার, ডগলাস ফার, বিভিন্ন প্রুস যেমন-রেড স্পুস, সিটকা প্রুস প্রভৃতি বৃক্ষ হল প্রধান।
[2] নদীতীর অঞ্চলে উইলো, অলডার, অ্যাসপেন, বার্চ, পপলার, বিচ, হেমলক প্রভৃতি বৃক্ষ দেখা যায়।
[3] যুক্তরাষ্ট্রে ডগলাস ফার বলে বিশেষ প্রজাতির ফার বৃক্ষ দেখা যায়। এই বৃক্ষই হল বৃহত্তম দীর্ঘ বৃক্ষ, যার উচ্চতা সর্বাধিক 85 মিটার ও ভূমিভাগের দিকে গাছের বেধ 3-4 মিটার।
[4] ভূমিভাগে লাইকেন ও মস দেখা যায়।
সরলবর্গীয় অরণ্য (Coniferous Forest)
বনভূমির বৈশিষ্ট্য
এই অঞ্চলের দীর্ঘ ও তীব্র শীতকাল এখানকার উদ্ভিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও রূপ দিয়েছে।
[1] চিরসবুজ: সরলবর্গীয় উদ্ভিদগুলি চিরসবুজ। তবে লার্চ চির সবুজ নয়।
[2] কোণবিশিষ্ট পাতা: শীতকালে গাছে তুষার যাতে জমতে না পারে তাই তুষার আক্রমণ প্রতিহত করতে গাছগুলির পাতা কোণবিশিষ্ট হয়।
[3] বৃক্ষের উচ্চতা: বৃক্ষগুলি 30 মি. পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তবে এই অরণ্যের কোনো কোনো রেডউড 100 মি. পর্যন্ত লম্বা হয়। বৃক্ষগুলির গড় ব্যাস প্রায় 20 মি. মতো হয়।
[4] একই প্রজাতির বৃক্ষের সমাবেশ: এই অরণ্যে একই প্রজাতির গাছের সমাবেশ লক্ষ করা যায়। যেমন রাশিয়ার তৈগা বনভূমিতে শত শত মাইল জুড়ে পাইন বৃক্ষ দেখা যায়।
[5] মোচাকৃতির বৃক্ষ: বৃক্ষগুলিতে যাতে বরফ না জমে তাই বৃক্ষগুলি মোচাকৃতির হয়ে থাকে এবং অত্যধিক শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বৃক্ষের ছালগুলি পুরু এবং কাণ্ডে খাদ্য সঞ্চিত থাকে।
[6] ডালপালা: এই ধরনের বৃক্ষগুলিতে ডালপালা কম থাকে এবং ডালগুলি খুব বেশি বড়ো হয় না। তাই অত্যধিক তুষারপাতেও এই বৃক্ষের ডাল সহজে ভাঙ্গে না।
[7] নরম ও হালকা কাঠ: এই বনভূমির অধিকাংশ বৃক্ষ যেমন-পাইন, ফার, প্রুস ইত্যাদি বেশ নরম ও হালকা হয়ে থাকে।
[৪] আগাছামুক্ত ভূমিভাগ: ভূমিভাগে 1-2 ফুট পর্যন্ত বরফ জমে থাকে বলে ভূমিতে কোনোরূপ লতা, আগাছা, পরগাছ জন্মাতে পারে না।
[9] অধিক কাঠ: এই ধরণের বৃক্ষগুলি অনেক বেশি লম্বা এবং মোটা হয় বলে কাঠের পরিমাণ খুব বেশি হয়।
[10] ফলমূল: ফল উৎপাদনে গাছগুলির বছর দুয়েক সময় লাগে। একবছর বীজ প্রজাতি হতে এবং পরের বছর করা। পাকতে সময় লাগে।
অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক গুরুত্ব বা ব্যবহার
[1] কাষ্ঠশিল্প: হালকা ও নরম কাঠ হিসাবে কাষ্ঠ শিল্প রূপে। এই বনভূমির কাঠের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যবহার দেখা যায়। পৃথিবীর কাষ্ঠ শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঠের ৪০% এই অরণ্যের কাঠ থেকে পাওয়া যায়। এই বনভূমির কাঠ। থেকে প্রচুর চেরাই কাঠ উৎপন্ন হয়, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কাঠের চাহিদা পূরণ করে।
[2] কাগজ উৎপন্ন: সরলবর্গীয় গাছ থেকে যে কাষ্ঠমণ্ড (Pulp) তৈরি করা হয় তা থেকেই বিশ্বের প্রায় 90% কাগজ উৎপাদিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা একত্রে বিশ্বের প্রায় 60% কাগজ উৎপাদন করে।
[3] কাঠ: পৃথিবীর প্রায় 50% কড়িকাঠ, প্রায় 67% তত্ত্বা, আসবাবপত্র, জাহাজের মাস্তুল, পাটাতন, নৌযান ও যানবাহনের প্রকোষ্ঠ প্রভৃতি এই অরণ্যের কাঠ থেকে তৈরি করা হয়।
[4] খেলাধূলার সরঞ্জাম তৈরি: এই বনভূমির কিছু বৃক্ষের কাঠ হালকা কিন্তু মজবুত, ফলে ওই বৃক্ষের কাঠ থেকে নানান খেলাধূলার সামগ্রী (ব্যাট, র্যাকেট ইত্যাদি) তৈরি হয়।
[5] সেলুলোজ উৎপাদন: পাইন, ফার, ম্প্রস প্রভৃতি বৃক্ষের কাঠ থেকে সেলুলোজ ও লিগনিন পাওয়া যায়, যা থেকে রাসায়নিক প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে কৃত্রিম রেয়ন প্রস্তুত করা হয়।
[6] বোর্ডনির্মাণ: এই অরণ্যের কাঠ থেকে মণ্ড তৈরি করে তা দিয়ে ফাইবার বোর্ড, পার্টিকল বোর্ড প্রভৃতি প্রস্তুত করা হয়।
[7] উপজাত দ্রব্য: পাইন গাছ থেকে পিচ, আলকাতরা ও বার্নিশ তৈরির অন্যতম উপাদান তার্পিন তেল পাওয়া যায়। চিরপাইন গাছের ছাল থেকে রজন পাওয়া যায়।
[৪] অন্যান্য দ্রব্য: এখানকার নরম কাঠ দিয়ে প্যাকিং বাক্স, চায়ের পেটি, দেশলাই প্রভৃতি তৈরি করা হয়।
সরলবর্গীয় অরণ্যে কান্তশিল্প গড়ে ওঠার কারণ বা উন্নতির কারণ
পৃথিবীর বাণিজ্যিক কাঠের অধিকাংশই (75-80%) এই বনভূমি থেকে ব্যবহার হয়। কানাডা, রাশিয়া, নরওয়ে, সুইজেই ফিনল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি উন্নত দেশগুলির সন্নিকটে এই বনভূমি অবস্থিত বলে অঞ্চলটি কাষ্ঠশিল্পে বেশ উন্নত। এই অঞ্চলে কাষ্ঠ শিল্পের উন্নতির কারণ হল-
[1] একই প্রজাতির বৃক্ষের প্রাপ্যতা: সরলবর্গীয় অরণ্যে একই প্রজাতির বৃক্ষ বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে জন্মায় বলে উপযোগী বৃক্ষ সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।
[2] সুলভ পরিবহন: এখানকার ভূমিভাগ সমতল বরফ আস্তর ঢাকা থাকে বলে একই সঙ্গে অনেকগুলি কাঠের গুঁড়ি তার দিয়ে বেধে শক্তিশালী মেশিন বা Donkey Engine-এ পিচ্ছিল বরফের ওপর সহজেই টেনে শিল্পকেন্দ্র নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে ব্যয়ও কম হয়।
[3] হালকা ও নরম কাঠ: এই অরণ্যের অধিকাংশ কাঠ হালকা ও নরম বলে সহজেই গাছ কাটা যায়, কম শ্রমিকে, কম সময়ে অনেক বেশি বৃক্ষচ্ছেদন করা সম্ভব হয়। কাঠ সংগ্রহে কম খরচ হয় বলে কাঠের উৎপাদন ব্যয়ও কম হয় যা এই অঞ্চলের কাষ্ঠশিল্পের প্রধান কারণ।
[4] অনুকূল জলবায়ু: এই অঞ্চলের জলবায়ু শীতল নাতিশীতোষ্ন হওয়ার জন্য শ্রমিকরা দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে পারে সহজে ক্লান্ত হয় না।
[5] সুলভ শ্রমিকের যোগান: এই অঞ্চলে গাছ কাটা, সংগ্রহ, কাঠ চেরাই, কলে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক পাওয়া যায় কারণ শীতকালে ভূমিভাগ বরফে আচ্ছাদিত থাকে বলে তেমন কোনো কৃষিকাজ থাকে না। ফলে বেশিরভাগ বৃক্ষ শীতকালেই কাটা হয়ে থাকে।
[6] পরিষ্কার ভূমিভাগ: এই বনভূমির তলদেশ আগাছামুক্ত বলে কাঠ সংগ্রহ করতে সহজেই বনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যায় এবং বিষাক্ত পোকামাকড়ের ভয় কম থাকে।
[7] প্রচুর চাহিদা: এই বনভূমি পৃথিবীর শিল্পোন্নত দেশগুলির নিকটে অবস্থিত বলে কাঠ, কাঠজাত দ্রব্য, কাগজ, আসবাবপত্রের প্রচুর চাহিদা থাকায় এই অঞ্চল কাষ্ঠশিল্পে উন্নত।
[৪] প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর সুবিধা: উন্নত প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোগত সুবিধা যেমন-দক্ষ শ্রমিক, মূলধনের যোগান, সুলভ জলবিদ্যুৎ, উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার প্রভৃতি কারণে কাষ্ঠশিল্প গড়ে উঠেছে।
[9] বনভূমির পুনর্নবীকরণ: নতুন গাছপালা লাগানোর মাধ্যমে বনভূমির পুনর্নবীকরণের বন্দোবস্ত কাগজ কলে কাঠ ও কাষ্ঠমণ্ডের যোগান অব্যাহত রাখতে সমর্থ হয়েছে।
Extra Knowledge:
1. দক্ষিন গোলার্ধে সরলবর্গীয় অরণ্য কম হওয়ার কারণ- সরলবর্গীয় অরণ্য সৃষ্টির জন্য বছরের অধিকাংশ তীব্র শীতল জলবায়ু এবং স্থলভাগ সমুদ্র উপকীল থেকে যথেষ্ট দূরে হওয়া প্রয়োজন। দঃ গোলার্ধে মোটামুটি 50°-70° দঃ অক্ষরেখার মধ্যবর্তী অংশে বেশিরভাগ স্থানেই জলভাগ।
2. সরলবর্গীয় গাছের পাতাগুলি সরু, লম্বা ও সূচালো বলে এই প্রকার বনভূমিকে Neddle
leaf forest বলে।
আরও জানুন:
1. জীব বৈচিত্র্যের অবলুপ্তির কারণগুলি লেখ? (What are the causes of Biodiversity loss)|
3. জীববৈচিত্র্য বিনাশের কারণ ও প্রভাব আলোচনা করো (Causes and Effect of Loss of Biodiversity)।
4. গ্রিন হাউস গ্যাস- গ্যাসগুলির উৎস, প্রভাব ও ফলাফল, নিয়ন্ত্রণকারী ব্যবস্থাসমূহ আলোচনা করো।
5. বিশ্ব উষ্ণায়নের (Global warming) কারণ ও প্রভাব আলোচনা করো।
6. দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যসহ তার শ্রেণীবিভাগ আলোচনা কর।