19th শতকে বাংলার শিক্ষা-ধর্ম-সামাজিক সংস্কারে রাজা রামমোহন রায় এর ভূমিকা লেখ?

Arpan

19th শতকে বাংলার শিক্ষা-ধর্ম-সামাজিক সংস্কারে রাজা রামমোহন রায় এর ভূমিকা লেখ?

বাংলার শিক্ষা-ধর্ম-সামাজিক সংস্কারে রাজা রামমোহন রায় এর ভূমিকা
বাংলার শিক্ষা-ধর্ম-সামাজিক সংস্কারে রাজা রামমোহন রায় এর ভূমিকা

ভূমিকা:-
19th শতকে প্রগতিশীল উদারপন্থী কিছু মানুষ নতুন ভাবনা-চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলার এক নবযুগের বার্তা বহন করে। এই নবযুগের অন্যতম বার্তা বহনকারী হলেন রাজা রামমোহন রায় ধর্মীয়, সামাজিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক চিন্তার জন্ম দিয়ে তিনি নিজেকে ভারতের প্রথম আধুনিক রুপে চিহ্নিত করেন। আর এরই মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে মহত্তর সূর্যোদয়ের আভাস সূচিত হয়।

শিক্ষা সংস্কার

রামমোহনের শিক্ষা চিন্তায় ভারতের অতীত ঐতিহ্য গৌরব জড়িত ছিল। তিনি সারাজীবন ধরে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যকে কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। তার শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল দেশবাসীকে বাস্তব জগতের উপযোগী করে তোলা।

1. আর্মহাস্টকে চিঠি:-
রামমোহন তৎকালীন গভর্নর আর্মহাস্টকে এক পত্র মারফত 1823 খ্রিস্টাব্দে ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য সরকারি অর্থ ব্যয়ের অনুরোধ জানান। এর পাশাপাশি তিনি গণিত, রসায়ন, প্রাকৃতিক বিদ্যা পরানোর কথা বলেন।

2. অ্যাংলো হিন্দু স্কুল স্থাপন:-
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে তিনি স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যত্নবান হন। নিজ প্রচেষ্টায় 1815 খ্রিস্টাব্দে তিনি অ্যাংলো হিন্দু স্কুল স্থাপন করেন।

3. হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা:-
কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন বলে অনেকে মনে করেন।

4. আলেকজান্ডার কে শিক্ষাক্ষেত্রে সাহায্য:-
পাশ্চাত্যবাদী আলেকজান্ডার ডাফকে “জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন গঠনে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

5. বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা:-
বেদান্ত শিক্ষার জন্য তিনি কলকাতায় 1826 খ্রিস্টাব্দে বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

6. অন্যান্য সংস্কার:-

  • গৌড়ীয় ব্যাকরণ সৃষ্টি:- বাংলায় শ্রীরামপুরে মিশনারীগণ বাংলা গদ্যে যে কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন রামমোহন তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
  • গ্রন্থসমূহ রচনা:- 1815-1823 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি ২৩ টি গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বেদান্ত গ্রন্থ, শহীদ বিচার, ব্রাহ্মণসেবা, বজ্রসূচি প্রভৃতি।
  • সংবাদপত্র পরিবেশন:- তিনি সংবাদপত্রের পরিবেশন এর ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের দিশারী ছিলেন। 1821 খ্রিস্টাব্দে সংবাদ কৌমুদী, 1822 খ্রিস্টাব্দে মীরাত উল আকবর ইত্যাদি সংবাদপত্র তিনি আবিষ্কার করেন। বিপিনচন্দ্রের মতে “Ram Mohan Roy was a pioneer of Indian Journalism”.

ধর্মীয় সংস্কার

1. সর্ব সমন্বয়বাদ:-
ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি এক যুক্তিবাদী মন নিয়ে চিন্তার স্বচ্ছতা উদার দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি হিন্দুদের প্রচলিত পৌত্তলিকতা কেন্দ্রিক আচার অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে তিনি সব ধর্মের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেন।

2. একেশ্বর বাদের প্রচার:-
তিনি হিন্দুদের দেবদেবীর মূর্তি পূজার বিশ্বাসী ছিলেন না। বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্র অধ্যায়ন করে তিনি বলেন সব ধর্মই মূল একেশ্বরবাদ। অর্থাৎ ঈশ্বর এক এবং অভিন্ন

3. আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা:-
ধর্মীয় সংস্কারের লক্ষ্যে তিনি 1815 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এর বিভিন্ন অধিবেশনে তিনি হিন্দু ধর্মের মূর্তি পূজার অসারতা, সতীদাহ জাতিভেদ প্রথা বিষয় আলোচনা করেন। এর সদস্য ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, নন্দকুমার বসু, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর।

4. ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা:-
1828 খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে তিনি তৎকালীন হিন্দু ধর্মের রক্ষকদের আঘাত করতে চেয়েছিলেন। এই সবার বিভিন্ন অধিবেশনে- বেদ, উপনিষদ-পাঠ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগীত পরিবেশিত হত।

5. বেদান্তের ভাষ্য রচনা:-
তিনি হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থের অন্তর্গত বেদান্ত এর বাংলা অনুবাদ করেন। এছাড়া তিনি উপনিষদের ভাবানুবাদ করেছিলেন।

সমাজ সংস্কার

গভীর মানবতাবাদ যুক্তিবাদে বিশ্বাসী রামমোহন ছিলেন সমাজ সংস্কার আন্দোলনের অগ্রদূত। তিনি পাশ্চাত্যের বিপুল পরিবর্তনের সঙ্গে ভারতকে সমান তালে চালাতে চেয়েছিলেন। এজন্যই তিনি ব্যাপক সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।

1. সতীদাহ প্রথার অবসান:-
হিন্দু সমাজের মধ্যে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় ছিল সতীদাহ প্রথা। স্বামীর চিতায় জীবিত স্ত্রীকে জোর করে পুড়িয়ে মারা হত। তার চিৎকার যাতে কেউ শুনতে না পায় তাহার জন্য ঢাক-ঢোল, কাঁসর বাজানো হত।
1800-1815 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে 2365 জন বিধবা কে সতী রূপে দহন করা হয়। এই প্রতিবাদে রামমোহন 300 জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর সহ আবেদন পত্র বেন্টিংক এর কাছে পাঠান। বেন্টিংক তার ডাকে সাড়া দিয়ে 17 নম্বর রেগুলেশন জারি করে সতীদাহ প্রথা বেআইনি বলে ঘোষণা করেন। : দিলীপ বিশ্বাস এর মতেসতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রামমোহনের আন্দোলনের মাধ্যমে চেতনার সহত্তার তার মহৎকীর্তি ছিল

2. নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা:-
স্বামীর মৃত্যুর পর যাতে তার বিধবা স্ত্রী স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে, তার জন্য তিনি স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়েও আন্দোলন করেন। কারণ তখন পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে নারীদের কোন অধিকার ছিল না।

3. কৌলিন্য প্রথা বাল্যবিবাহের বিরোধিতা:-
রামমোহন কৌলিন্য প্রথার বিরোধী ছিলেন। কারণ এই প্রথার জন্যই সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় অল্পবয়স্ক মেয়েদের মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হত।

3. বহুবিবাহের বিরোধিতা:-
তিনি ভারতীয় শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে প্রাচীন শাস্ত্রে পুরুষের বহু বিবাহের যথেষ্ট অধিকার দেওয়া হয়নি। তবে প্রাচীনকালে কোন স্ত্রী ব্যভিচারিনি, সুরাসক্ত বন্ধ্যা হলে পুরুষ পুনরায় বিবাহ করতে পারে।

5. জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা:-
রামমোহন রায় এই প্রথার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে সমাজের মানুষের ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বজ্রসূচী বাংলা অনুবাদ করে প্রচার করেন।

উপসংহার:-
অবশেষে বলা যায়, রামমোহনের চিন্তাধারা, কর্ম নৈপূণ্য ভারতীয় ধর্ম সমাজের ক্ষেত্রে যে নবজাগরণের সৃষ্টি করেছিল তার সমগ্র উনবিংশ শতাব্দীর সংস্কার আন্দোলন কে প্রভাবিত করেছিল। : বিপিনচন্দ্র এর মতে “Rammohan was the brightest star in Indian sky during the first half of the 19th century, but he was not a lone star”

Post a Comment

এই তথ্যের ব্যাপারে আরো কিছু জানা থাকলে বা অন্য কোনো প্রশ্ন থাকলে এখানে লিখতে পারেন ।