ভাইরাস – বৈশিষ্ট্য, সাধারণ গঠন, প্রকারভেদ, বংশবৃদ্ধি, উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস

Arpan

ভাইরাসবৈশিষ্ট্য, সাধারণ গঠন, প্রকারভেদ, বংশবৃদ্ধি, উদ্ভিদ প্রাণী দেহে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস

ভাইরাস
ভাইরাস

ভাইরাস (Virus)

ভাইরাস এর ধারণা (Concept of Virus)

ভাইরাস হল, নিউক্লিক অ্যাসিড প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত এক অতি-আণুবীক্ষণিক অকোশীয় সত্ত্বা যা কেবল উপযুক্ত জীবকোশের অভ্যন্তরে বংশবৃদ্ধি করতে পারে এবং বিশেষ বিশেষ রোগ সৃষ্টি করতে পারে। অথচ জীবদেহের বাইরে জড় পদার্থের মতো অবস্থান করে।

ভাইরাসের বাসস্থান (Habitat of Virus)

ভাইরাস জীব জড় উভয় পরিবেশেই বাস করে, তবে সজীব দেহে ভাইরাস সক্রিয় থাকে। উদ্ভিদ, প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া, সায়ানোব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক প্রভৃতি জীবদেহের সজীব কোশে ভাইরাস সক্রিয় অবস্থান করতে পারে।

ভাইরাসের আয়তন (Size of Virus)

ভাইরাস অতিক্ষুদ্র জীবসত্তা, ইলেক্ট্রণ অণুবীক্ষণযন্ত্র ছাড়া এগুলো দেখা যায় না। ভাইরাসের গড় ব্যাস 8-300 ন্যানোমিটার (nm) ভ্যাকসিনিয়া ভিরিওলা ভাইরাসগুলো বেশ বড় 280-300 ন্যানোমিটার পর্যন্ত হয়। গবাদি পশুর ফুট অ্যান্ডি মাউথ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস সবচেয়ে ক্ষুদ্র 8-12 ন্যানোমিটার।

ভাইরাস এর বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Virus)

ভাইরাসের বৈশিষ্ট্যগুলিকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা হয়-

A. জড়-রাসয়নিক বৈশিষ্ট্য:-

  1. ভাইরাস আকোশীয় অতিআণুবীক্ষণিক সাইটোপ্লাজম বিহীন রাসয়নিক পদার্থ।
  2. পোষক দেহের বাইরে এরা কোনো জৈবনিক কার্যকলাপ ঘটাতে সক্ষম নয় অর্থাৎ বহিঃকোশীয় দশায় জড়ের মতো আচরণ করে।
  3. ভাইরাস, নিউক্লিয়াসবিহীন হয়ে থাকে।
  4. এরা পরিবেশিক উদ্দীপনায় সাড়া দেয় না।
  5. পরিস্রুত কেলাসিত করে একে স্ফটিকে পরিণত করা সম্ভব।
  6. এদের নিজস্ব কোনো বিপাকীয় এনজাইম নেই।
  7. ভাইরাস রাসয়নিকভাবে প্রোটিন নিউক্লিক অ্যাসিডের সমাহার।

B. জীবীয় বৈশিষ্ট্য:-

  1. জৈবিক গঠনগত ভাবে ভাইরাসের দেহে নিউক্লিক অ্যাসিড (DNA বা RNA -এর মধ্যে যে-কোনো একটি উপাদান) থাকে। এখানে নিউক্লিক অ্যাসিড নিউক্লিওপ্রোটিন দ্বারা আবৃত থাকে, একে ক্যাপসিড বলা হয়।
  2. অন্তঃকোশীয় দশায় পোষক কোশের অভ্যন্তরে জীবের মতো আচরণ করে। উপযুক্ত পোষক কোশের অভ্যন্তরে ভাইরাস সংখ্যাবৃদ্ধি (multiplication) করতে সক্ষম।
  3. ভাইরাস পোষক কোশে সংক্রমিত হয়।
  4. ভাইরাস সুনির্দিষ্টভাবে বাধ্যতামূলক পরজীবী।
  5. ভাইরাসের অভিযোজন, প্রকরণ পরিব্যক্তি ক্ষমতা থাকে।
  6. কোনোরকম বিপাকীয়-ক্রিয়া ভাইরাস দেহে লক্ষ্য করা যায়না।
  7. নতুন সৃষ্ট ভাইরাসে মাতৃভাইরাসের সকল বৈশিষ্ট্যই বজায় থাকে। অর্থাৎ একটি ভাইরাস তার অনুরূপ ভাইরাস সৃষ্টি করতে পারে।

ভাইরাসের সাধারণ গঠন (General Structure of Virus)

1. ভাইরাস দেহের গঠনগত প্রধান দুটি উপাদান হল-

·        বহিরাবরণ বা ক্যাপসিড (প্রোটিন) এবং

·        ক্যাপসিড মধ্যস্থ নিউক্লিক অ্যাসিড বা নিউক্লিওয়েড।

2. ক্যাপসিড অসংখ্য ক্যাপসোমিয়ার নামক প্রোটিনের সাব-ইউনিট বা উপ-একক দ্বারা গঠিত।

3. ক্যাপসিড প্রধানত প্রোটিন দ্বারা গঠিত হলেও অনেকক্ষেত্রে এতে স্নেহ পদার্থ শ্বেতসারও পাওয়া যায়।

4. ক্যাপসিড মধ্যস্থ নিউক্লিক অ্যাসিড বা নিউক্লিওয়েডকে রক্ষা করা ক্যাপসিডের প্রধান কাজ।

5. নিউক্লিওয়েড বা ক্যাপসিড মধ্যস্থ নিউক্লিক অ্যাসিডকে ভাইরাস-জিনোম বলা হয়। 6. নিউক্লিওয়েড সর্বদা যে কোনো একপ্রকার নিউক্লিক অ্যাসিড অর্থাৎ DNA বা RNA-এর মধ্যে যেকোনো একটি উপাদান দ্বারা গঠিত।

7. DNA বা RNA একসূত্রক বা দ্বিসূত্রক হয়ে থাকে। কলিফাজ একটি একসূত্রক DNA ভাইরাসের আদর্শ উদাহরণ। আবার TMV হল একসূত্রক RNA যুক্ত ভাইরাস। অন্যদিকে দ্বিসু এক DNA বা RNA বিশিষ্ট ভাইরাস যথাক্রমে T2, T4 ফাজ ভাইরাস এবং রিওভাইরাস।

8. কিছু সংখ্যক প্রাণী ভাইরাস, খুবই কম সংখ্যক উদ্ভিদ ব্যাকটেরিয়াল ভাইরাসের ক্ষেত্রে সাধারণত নিউক্লিওক্যাপসিড বা নিউক্লিওপ্রোটিন কণার বাইরে পুরু বহিরাবরণ এনভেলপ লক্ষ্য করা যায়।

9. ভাইরাসের দেহে সবসময় এনজাইম থাকে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এনজাইমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন ব্যাকটেরিওফাজে লাইসোজাইম, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে নিউরামিনিডেজ ইত্যাদি।

ভাইরাসের প্রকারভেদ (Types of Virus)

1. আকার অনুযায়ী ভাইরাসকে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়

[i] দন্ডাকার- টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV), আলফা-আলফা মোজাইক ভাইরাস, মাম্পস্ ভাইরাস।

[ii] গোলাকার- পোলিও ভাইরাস, ডেঙ্গি ভাইরাস, HIV ভাইরাস।

[iii] ঘনক্ষেত্রাকার- ভাকসিনিয়া ভাইরাস, হ্যপিস ভাইরাস।

[iv] ব্যাঙাচি আকার- T2, T4, T6 ফাজ ভাইরাস।

[v] ডিম্বাকার- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস।

[vi] সিলিন্ড্রিকাল- ইবোলা ভাইরাস।

2. ভাইরাস দেহে উপস্থিত নিউক্লিক অ্যাসিডের ধরণ অনুযায়ী ভাইরাসকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়

[i] DNA ভাইরাস

· একতন্ত্রী DNA ভাইরাস: জেমিনি ভাইরাস, কলিফাজ পারভো ভাইরাস এবং

· দ্বিতন্ত্রী DNA ভাইরাস: অ্যাডিনো ভাইরাস, হার্পিস ভাইরাস।

[ii] RNA ভাইরাস

· একতন্ত্রী RNA ভাইরাস: টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV), পোলিও ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এবং

· দ্বিতন্ত্রী RNA ভাইরাস: রিওভাইরাস, ধানের বামন রোগের ভাইরাস।

এছাড়াও একধরনের DNA RNA উভয়যুক্ত ভাইরাস লক্ষ্য করা যায়। লিউকো ভাইরাস, রাউস সারকোমা, ক্ল্যামাইডিয়া সিটাসি প্রভৃতি DNA RNA উভয়যুক্ত ভাইরাসের আদর্শ উদাহরণ।

3. ভাইরাস পরজীবী হওয়ায় পোষকদেহ অনুযায়ী ভাইরাসকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়

[i] উদ্ভিদ ভাইরাস- টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV)

[ii] প্রাণী ভাইরাস- পোলিও ভাইরাস, HIV ভাইরাস।

[iii] ব্যাকটেরিওফাজ- ব্যাকটেরিয়া বিনিষ্টকারী T2 ভাইরাস T4 T6 ফাজ ভাইরাস।

[iv] ডিম্বাকার- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস।

[v] সিলিন্ড্রিকাল- ইবোলা ভাইরাস।

4. বাহ্যিক আবরণ অনুযায়ী ভাইরাসকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়

[i] আবরণবিহীন ভাইরাস- টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV), ব্যাকটেরিয়া বিনিষ্টকারী T2 ভাইরাস।

[ii] আবরণযুক্ত ভাইরাস- HIV ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস।

5. পোষকদেহে সংক্রমণ অনুযায়ী ভাইরাসকে বিভক্ত করা হয়-

যেমনসংক্রমণকারী সাধারণ ভাইরাস রেট্রোভাইরাস। রাউস সারকোমা ভাইরাস, বোভাইন লিউকমিয়া ভাইরাস এবং HIV হলো রেট্রোভাইরাস। এখানে ভাইরাল DNA থেকে RNA তৈরি হয়।

ভাইরাসের সংখ্যাবৃদ্ধি বা বংশবৃদ্ধি (Replication of Virus)

যেহুতু ভাইরাস প্রকৃত জীব নয়; সেকারণে একটি ভাইরাস কণা থেকে আরেকটি অপত্য ভাইরাস কণা সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে কোনো ভাবেই ভাইরাসের জীবনচক্র বলা যায় না। একে সংখ্যাবৃদ্ধি প্রক্রিয়া হিসেবে ধরা হয়। ভাইরাসের সংখ্যাবৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায় 1. লাইটিক চক্র বা ভাইরুলেন্ট চক্র এবং 2. লাইসোজেনিক চক্র বা টেমপারেট চক্র।

1. লাইটিক চক্র বা ভাইরুলেন্ট চক্র:-

যে প্রক্রিয়ায় ফাজ ভাইরাস পোষক ব্যাকটেরিয়া কোশে প্রবেশ করে সংখ্যা বৃদ্ধি সম্পন্ন করে এবং অপত্য ভাইরাসগুলো পোষকদেহের বিদারণ বা লাইসিস ঘটায়, তাকে লাইটিক চক্র বা ভাইরুলেন্ট চক্র বলে। E. coli (Escherichia coli) নামক ব্যাকটেরিয়ায় T2 ফাজ ভাইরাস লাইটিক চক্রের মাধ্যমে সংখ্যাবৃদ্ধি সম্পন্ন করে।

2. লাইসোজেনিক চক্র বা টেমপারেট চক্র:-

যে প্রক্রিয়ায় ফাজ ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার কোশে প্রবেশ করার পর ভাইরাল DNA-টি অণুর সাথে সংযুক্ত হয় এবং ব্যাকটেরিয়াল DNA- সাথে একত্রে প্রতিলিপি গঠন করে কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস রূপে ব্যাকটেরিয়া কোশের বিদারণ ঘটিয়ে মুক্ত হয় না, তাকে লাইসোজেনিক চক্র বা টেমপারেট চক্র বলে। E. coli ব্যাকটেরিয়া আক্রমনকারীর ল্যামডা ফাজ - লাইসোজেনিক চক্র লক্ষ্য করা যায়।

উদ্ভিদ দেহে রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকারক উল্লেখযোগ্য ভাইরাস সমূহ (Harmful Viruses that cause diseases in Plants)

উদ্ভিদ দেহে রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকারক উল্লেখযোগ্য ভাইরাস সমূহ
উদ্ভিদ দেহে রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকারক উল্লেখযোগ্য ভাইরাস সমূহ

প্রাণী দেহে রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকারক উল্লেখযোগ্য ভাইরাস সমূহ (Harmful Viruses that cause diseases in Animals)

প্রাণী দেহে রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকারক উল্লেখযোগ্য ভাইরাস সমূহ
প্রাণী দেহে রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকারক উল্লেখযোগ্য ভাইরাস সমূহ

সাধারণ জ্ঞান (General Knowledge):-

  1. বৃহত্তম ভাইরাস মেগাভাইরাস (440nm )
  2. ক্ষুদ্রতম ভাইরাস পরসিন সার্কোভাইরাস টাইপ 1 (17nm) এটি একটি একতন্ত্রী DNA ভাইরাস।
  3. অনেকক্ষেত্রে ভাইরাসের ক্যাপসিডের বাইরে সর্করা, প্রোটিন লিপিড দ্বারা গঠিত আবরণী লক্ষ্য করা যায়, একে এনভেলপ বলে।
  4. ক্যাপসিডবিহীন কেবল RNA যুক্ত ভাইরাসকে ভাইরয়েড বলে। যেমন- ভাইরাস। পোটাটো স্পিন্ডিল ভাইরাস এবং রাউস ভাইরাস।
  5. যে ভাইরাস অন্য ভাইরাসের সাহায্যে পোষক কোশে প্রবেশ করে, তাকে স্যাটেলাইট ভাইরাস বলে। যেমন- AAV ভাইরাস।
  6. পোষক কোশ থেকে যে পদার্থ ভাইরাস আক্রমণের প্রভাবে নিঃসৃত হয় এবং ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধ করে, তাকে ইন্টারফেরন বলে।
  7. সংক্রমণযোগ্য একটি বিচ্ছিন্ন ভাইরাস একককে ভিরিয়ন বলে।
  8. জীবদেহে সংক্রমণে সক্ষম এবং প্রান্ত ভাঁজযুক্ত প্রোটিনকে প্রায়ন বলে।
  9. HIV-সহ সকল রেট্রোভাইরাসের দেহে রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ নামক উৎসেচক থাকে। এই রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ-এর সাহায্যেই HIV রেট্রোভাইরাসে উপস্থিত RNA থেকে DNA তে সংশ্লেষিত হয়

আরও জানুন:

Post a Comment

এই তথ্যের ব্যাপারে আরো কিছু জানা থাকলে বা অন্য কোনো প্রশ্ন থাকলে এখানে লিখতে পারেন ।