সাম্রাজ্যবাদ কাকে বলে ও উদ্ভবের কারণ গুলি আলোচনা করো ।

সাম্রাজ্যবাদ কাকে বলে ?

সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা সম্পর্কে বিভিন্ন ইতিহাসবিদের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে ।

1. লেনিনের মত 
ভি. আই. লেনিন তার Imperialism The Highest Stage of Capitalism গ্রন্থে লিখেছেন সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদের একচেটিয়া জায়গা ।

2. হবসনের মত
জন. এ. হবনসন তার Imperialism A Study গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন প্রাথমিক স্তরে জাতীয়তাবাদ অন্যদেশে উপনিবেশ গড়ে তোলার প্রেরণা জাগায় এবং পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদের রূপ নেয় ।

3. মর্গানথার্ড এর মত
অধ্যাপক হ্যান্স মরগ্যানথাউ এর ধারণায় নিজ এলাকার বাইরে রাষ্ট্রক্ষমতার সম্প্রসারণই হলো সাম্রাজ্যবাদ ।

4. সুম্যান এর মত

সুম্যাণ এর মতে বলপ্রয়োগ ও হিংসার সাহায্যে কোনো দেশের ওপর বৈদেশিক শাসন চাপিয়ে দেওয়াকে  সাম্রাজ্যবাদ বলে ।

সাধারণভাবে বলা যায় সাম্রাজ্যবাদ এমন এক নীতি বা কার্যক্রম যাতে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে । অধিকতর শক্তিশালী দেশ কতৃক অপেক্ষাকৃত দুর্বল তর দেশের উপর বৈদেশিক রাষ্ট্র ও সরকারের উপর আধিপত্য স্থাপন সাম্রাজ্যবাদ নামে অবিহিত । অন্যদিকে একটি দেশের অন্য দেশে আধিপত্য স্থাপন করে বসতি গড়ে তোলা বা শাসন করার যে ঘটনা তা উপনিবেশবাদ নামে অভিহিত । এই উপনিবেশবাদ পরোক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদের ই নামান্তর ।

সাম্রাজ্যবাদ উদ্ভবের কারণ :


আধুনিক পৃথিবীতে উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন কারণ রয়েছে ।

ক) রাজনৈতিক কারণ

সাম্রাজ্যবাদ প্রসারে রাজনৈতিক কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হলো উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা -

1. উগ্র জাতীয়তাবাদ
১৮৭০ দশকের পর থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । প্রতিটি জাতি মনে করে যে, তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি এবং পৃথিবী শাসন করার অধিকার একমাত্র তাদের আছে । ইংল্যান্ড, জার্মান, রাশিয়া, ইতালি প্রভৃতি দেশ তাদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে উদ্যোগ হয় । পারস্পরিক সন্দেহ, বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায় এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি শুরু হয়। এই পরিস্থিতি তে ইউরোপের দেশগুলি এশিয়া, আফ্রিকার মত অনুন্নত দেশগুলিতে নিজেদের রাজনীতির প্রসার ঘটায় ।

2. ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা

ইউরোপের দেশ গুলি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পত্তি বাড়ানোর জন্য উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হয় । ইতালি, জার্মান সহ বিভিন্ন দেশ কেবলমাত্র রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য উপনিবেশ স্থাপনে অগ্রসর হয়।

খ) অর্থনৈতিক কারণ

সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক কারণ গুলি হল -

1. কাচামাল সংগ্রহ
শিল্প বিপ্লব জনিত কারণে ইউরোপের শিল্প উন্নত দেশগুলির কারখানায় খুব অল্প সময়ে প্রচুর পরিমাণে শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন করতে থাকে এবং এই উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন ছিল পর্যাপ্ত কাঁচামাল। এ কাঁচামালের যোগান সংশ্লিষ্ট দেশে পাওয়া সম্ভব ছিল না ফলে স্বাভাবিক ভাবে বাইরে থেকে কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি সুকৌশলে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উপনিবেশিকতার প্রসার ঘটায় ।

2. বাজার দখল
ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য বাজার দখলের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যেহেতু ইউরোপের প্রতিটি দেশেই আফ্রিকার অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদিত হয়, তাই তাদের কাছে এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত অঞ্চলগুলিতে বাজার দখল অনিবার্য হয়ে পড়ে । যে কারণে তারা উপনিবেশ স্থাপনের সচেষ্ট হন।

3. পুঁজি বিনিয়োগ
হবসন এবং লেনিন মনে করতেন বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে শিল্পোন্নত দেশগুলি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চল গুলিকেই বেছে নিয়েছিল।

4. সস্তায় শ্রমিক সংগ্রহ
শিল্পোৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং ইউরোপের কল-কারখানা গুলিতে কার্যক্রম দানের জন্য সস্তায় প্রচুর সংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল, যে কারণে তারা উপনিবেশ স্থাপনের আগ্রহী হন।

গ) সামরিক কারণ

ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের সামরিক কারণ গুলি হল -

1. নিরাপত্তা বৃদ্ধির চেষ্টা
১৮৭০ এর দশকের পর থেকে সাম্রাজ্যবাদের যে প্রসার ঘটেছিল তার ফলস্বরূপ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ, বিদ্বেষ, হিংসা প্রভৃতি বৃদ্ধি পায়, এই কারণে এই সমস্ত দেশের প্রয়োজন ছিল একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা । এইজন্য দেশগুলি নিজেদের দেশের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে থাকে।

2. সামরিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা

ইউরোপের অনেক দেশ কেবলমাত্র নিজেদের সামরিক শক্তি ও মর্যাদা তুলে ধরার জন্য উপনিবেশ স্থাপনের পথ বেছে নেয়।

ঘ) সামাজিক কারণ

ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদের সামাজিক কারণ গুলি হল - 

1. জনসংখ্যা বৃদ্ধি
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই বর্ধিত জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের জন্য এই সমস্ত দেশের কাছে উপনিবেশ দখল করা জরুরী হয়ে পড়েছিল।

2. সভ্যতার প্রসার
সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাবিদ যেমন ধুডিয়ার্ড বিপলিং কিংবা ফরাসি লেখন যুলিস ফেরি মনে করেন যে এশিয়া, আফ্রিকার অনুন্নত মানুষদের উন্নত করার জন্য সাদা চামড়ার মানুষদের কাছে দায়বদ্ধতা আছে।

ঙ) ধর্মীয় কারণ

ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের ধর্মীয় কারণ গুলি হল -

1. ধর্ম প্রচার
ইউরোপের খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলিতে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে অন্ধকারাচ্ছন্ন জাতি গুলিকে আলোর জগতে আনার উদ্দেশ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন এই সমস্ত ধর্মপ্রচারকদের অনুসরণ করে ইউরোপ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।

চ) প্রযুক্তিগত কারণ

আধুনিককালে কেউ কেউ মনে করেন যে প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতিতে মন উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা যন্ত্রচালিত যান, ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের অভিযান স্পৃহা কে বাড়িয়ে দিয়েছিল । ফিলিপ কর্টিন, লিওনার্ড থম্পসন, ড্যানিয়েল হেনবিক প্রমুহ ।

Post a Comment

এই তথ্যের ব্যাপারে আরো কিছু জানা থাকলে বা অন্য কোনো প্রশ্ন থাকলে এখানে লিখতে পারেন ।