মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলতে কী বোঝো ? উপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব প্রেক্ষাপট ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো ।
1757 খ্রিস্টাব্দে পলাশী যুদ্ধের পর থেকে ভারতে ব্রিটিশ শক্তির প্রসার ঘটতে থাকে। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের সমাজ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব। এই সময় মোটামুটি সচ্ছল আর্থিক অবস্থা সম্পন্ন ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে তাকে সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বলা হয়।
উদ্ভবের ভিত্তিতে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন
1. ভূমিজ মধ্যবিত্ত শ্রেণী
2. শিল্পজ মধ্যবিত্ত শ্রেণি
3. শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি
উদ্ভবের প্রেক্ষাপট
করণিক:
ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধারাবাহিক প্রচারের ফলে এক বিরাট প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই প্রশাসনের কাজ কর্মের জন্য উচ্চপদ গুলিতে ইংরেজি রান্নাঘরে ও নিম্নস্তরের পদগুলিতে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়দের নিয়োগ করা হয় । এইসব মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
আইনজীবী:
ইংরেজরা ভারতে প্রাশ্চাত্যের ধাঁচে আইন ও বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে মামলা মোকাবিলা সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পায়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত প্রচুর ভারতীয় অত্যন্ত লাভজনক আইন পেশায় নিযুক্ত হয় । এইভাবে আমলা উকিল-মোক্তার প্রভৃতি পেশার সঙ্গে যুক্ত ভারতীয়দের উদ্ভব ঘটে।
বাণিজ্যের কাজে যুক্ত কর্মী :
ইংরেজরা ভারতে এসেছিল মূলত বাণিজ্য করতে। বাণিজ্যের প্রসার ঘটার ফলে এই বিশাল আকার বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রচুর কর্মচারীর প্রয়োজন হয়। ব্রিটিশ বণিকদের তাদের বাণিজ্যিক কাজকর্ম শেখানোর জন্য শিক্ষিত ভারতীয়দের নিয়োগ করত। এই ভারতীয়রা মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
সামরিক বিভাগের কর্মী :
ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উন্নতির জন্য ব্রিটিশ সরকার বিশাল সামরিক বাহিনী গড়ে তুলেছিল। সামরিক বিভাগের নিম্ন পদগুলিতে প্রচুর পরিমাণে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হতো। এই সামরিক কর্মীরা মধ্যবিত্ত ভারতীয় নামে পরিচিত।
শিল্পের সঙ্গে ভারতীয় শ্রেণি :
ইংরেজরা ভারতের শিল্প ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ নিয়োগ করে। তাদের উদ্যোগে লৌহ কপাট ইঞ্জিনিয়ারিং কাগজ চা-কফি প্রভৃতি শিল্পের বিকাশ ঘটে। এসব কারখানায় কাজ পরিচালনার জন্য প্রচুর ভারতীয়দের নিয়োগ করা হয়, এরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি নামে পরিচিত।
সরকারি অফিসের কর্মী :
ভারতে ব্রিটিশদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর থেকে এ দেশের সরকারি স্কুল, কলেজ, আদালত, হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কর্মে নিযুক্ত ভারতীয় মানুষ মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত।
ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো
ব্রিটিশ শাসনকালে গড়ে ওঠা ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারত প্রশাসনের অন্যতম ফসল । এই সময় সৃষ্টি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় সেগুলি হলো -
উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রধান :
ব্রিটিশ শাসন ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছিল, তার সংখ্যাগরিষ্ঠ উচ্চবর্ণের হিন্দু 1883 - 84 শিক্ষাবর্ষে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে 84.7 শতাংশ এসেছিল ব্রাম্ভন ও বৈষ্ণব ও কায়স্থ এই তিনটি শ্রেণী থেকে।
প্রাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ :
উপনিবেশিক আমলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় আগ্রহ। মধ্যবিত্ত শ্রেণি আর্থিক সমর্থন হলেও তারা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের ফলে ভারতীয় সমাজে প্রগতিশীল মানসিকতার পরিচয় দেয়।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি :
ব্রিটিশ শাসনকালে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট ভাল ছিল। মধ্যবিত্তদের মধ্যে অনেক ছিলেন ভূস্বামী জমিদার, মহাজন, পুঁজিপতি প্রচুর সম্পত্তির মালিক। এছাড়াও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষরা বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত চাকরি করতেন।
সাম্প্রদায়িক সচেতনতা :
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষরা নিজেদের সাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তারা কয়েকটি জাতীয় নির্ভর গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন আবার নিজ সম্প্রদায়ের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সচেতন ছিলেন।
শহর কেন্দ্রিকতা :
কোম্পানির শাসনকালে ভারতে বহু নতুন শহর প্রতিষ্ঠা হয়। এছাড়াও সরকারি অফিস-আদালত বিচারপতি উচ্চপদস্থ ব্যক্তিত্বদের বাসভবন রাস্তাঘাট প্রভৃতি গড়ে ওঠে। এই শহরগুলি কে কেন্দ্র প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং মধ্যশ্রেণী এই শিক্ষার সুযোগ পায়।
বেকারত্ব :
ভারতে এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রধানত ব্রিটিশদের অধীনে চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করত কিন্তু এ সম্প্রদায় পরবর্তীকালে কর্মহীনতার মুখোমুখি হয়। যোগ্যতা থাকলে মধ্যবিত্তরা নিম্ন পদের চাকরিগুলোতে নিযুক্ত হতে বাধ্য হতো।